টোকন ঠাকুর — শেষের পরে

টোকন ঠাকুর ⤵
—শেষের পরে
হতে পারে, সব কথা শেষ হয়ে গেছে
সব ভাষা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে তুসোর জাদুঘরে
যতিচিহ্ন মুছে গেছে সব, রাস্তায় কোনো বিশ্রাম-বিরতি নেই
গন্তব্যপুরের গ্রাম আর চোখেই পড়ে না
তাহলে, এর পরের অবস্থা কী?

কী রেখে যাচ্ছি তবে পুরোনো নদীর কাছে, যে নদীতে একদিন
ভেসে গেছে বেহুলাবান্ধব ঢেউ, সহস্র কবিতা!
কী এঁকে রাখছি তবে চিরকালের মহাদিগন্ত-ফলকে?

কথা যদি শেষ হয়ে যায়, ভাষা যদি লিখে দেয় ‘সমাপ্ত’
কী দিয়ে যাচ্ছি তবে তরুণ কবির হাতে? কী? কী?

তারই-বা কী হবে, কেবলই নতুন বাক্যে ডুব দিয়ে সারা রাত নির্ঘুম
যে মেয়েটি একটি নতুন কবিতা পড়েই পোড়ে ধিকিধিকি! ⤵

অক্টোবর ৩১, ২০১৪

কাইয়ুম চৌধুরী — হেমন্তে যমুনা

কাইয়ুম চৌধুরী ⤵
—হেমন্তে যমুনা

ধূলিওড়া হেমন্তের ধান তোলা মাঠে
লালশাড়ি একাকিনী
নাকছাবি দোলে
ছাগশিশু কোলে
হলুদ প্রান্তর ঘেঁষা বটবৃক্ষ তলে
মঙ্গলহাট—
সুবালার হাতে নকশীবয়ন
ফুলের চয়ন
বিকিকিনির কোলাহল কেমন জমাট।

ভাদ্রের ঘর্মাক্ত তাপ
শ্যামল মুখে উড়ন্ত চিকুরে
গোধূলির জলছাপ—
সুরলহরী কর্ণকুহরে
বহু পুরাতন
লোকজ কথন
ছহিবড় জঙ্গনামা
অতিক্রান্ত হয় কোজাগরি ত্রিযামা।

হেঁটে আসে কারা
ঢেঁকি ছাঁটা চাল কোঁচড়ে বাঁধা
হাটিকুমরুল বাজায় দোতারা।

ভাঙনের শব্দ শোনে যমুনার তীর
শর্ষে খেতে ছাওয়া জমি-জিরাত
নদীগর্ভে বিলীন বিধাতার হাত।

এমনই কপাল
শস্যহীন জাল—
এখনো সুবাস ছড়ায় রসের পিঠে
জয়নবের হাতে।

হেমন্তসন্ধ্যায় ঘুঘুর বিষণ্ন ডাক
ভেঙে পড়ে নদীতীর
যমুনার বাঁক। ⤵

অক্টোবর ৩১, ২০১৪

স্পর্শমণি

– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

নদীতীরে বৃন্দাবনে সনাতন একমনে
জপিছেন নাম,
হেনকালে দীনবেশে ব্রাহ্মণ চরণে এসে
করিল প্রণাম।
শুধালেন সনাতন, “কোথা হতে আগমন,
কী নাম ঠাকুর?’
বিপ্র কহে, “কিবা কব, পেয়েছি দর্শন তব
ভ্রমি বহুদূর।
জীবন আমার নাম, মানকরে মোর ধাম,
জিলা বর্ধমানে–
এতবড়ো ভাগ্যহত দীনহীন মোর মতো
নাই কোনোখানে।
জমিজমা আছে কিছু, করে আছি মাথা নিচু,
অল্পস্বল্প পাই।
ক্রিয়াকর্ম-যজ্ঞযাগে বহু খ্যাতি ছিল আগে,
আজ কিছু নাই।
আপন উন্নতি লাগি শিব-কাছে বর মাগি
করি আরাধনা।
একদিন নিশিভোরে স্বপ্নে দেব কন মোরে–
পুরিবে প্রার্থনা!
যাও যমুনার তীর, সনাতন গোস্বামীর
ধরো দুটি পায়!
তাঁরে পিতা বলি মেনো, তাঁরি হাতে আছে জেনো
ধনের উপায়।’

শুনি কথা সনাতন ভাবিয়া আকুল হন–
“কী আছে আমার!
যাহা ছিল সে সকলি ফেলিয়া এসেছি চলি–
ভিক্ষামাত্র সার।’
সহসা বিস্মৃতি ছুটে, সাধু ফুকারিয়া উঠে,
“ঠিক বটে ঠিক।
একদিন নদীতটে কুড়ায়ে পেয়েছি বটে
পরশমানিক।
যদি কভু লাগে দানে সেই ভেবে ওইখানে
পুঁতেছি বালুতে–
নিয়ে যাও হে ঠাকুর, দুঃখ তব হবে দূর
ছুঁতে নাহি ছুঁতে।’

বিপ্র তাড়াতাড়ি আসি খুঁড়িয়া বালুকারাশি
পাইল সে মণি,
লোহার মাদুলি দুটি সোনা হয়ে উঠে ফুটি,
ছুঁইল যেমনি।
ব্রাহ্মণ বালুর ‘পরে বিস্ময়ে বসিয়া পড়ে–
ভাবে নিজে নিজে।
যমুনা কল্লোলগানে চিন্তিতের কানে কানে
কহে কত কী যে!
নদীপারে রক্তছবি দিনান্তের ক্লান্ত রবি
গেল অস্তাচলে–
তখন ব্রাহ্মণ উঠে সাধুর চরণে লুটে
কহে অশ্রুজলে,
“যে ধনে হইয়া ধনী মণিরে মান না মণি
তাহারি খানিক
মাগি আমি নতশিরে।’ এত বলি নদীনীরে
ফেলিল মানিক।

২৯ আশ্বিন, ১৩০৬